শাহ্দীন মালিক
গত বছর, ২০১১ সালের ৩ জুলাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদ পাস করেছিল। ক্যালেন্ডারের হিসাবে আজ প্রথম বর্ষপূর্তি।
আমরা সচরাচর কোনো সাফল্য বা বেদনার বর্ষপূর্তি পালন করি। সংবিধানের সংশোধনী বর্ষপূর্তি পালনের মতো জাতীয়ভাবে তেমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। পার্শ্ববর্তী ভারতের প্রতিটি সংবিধান সংশোধনীর বর্ষপূর্তি পালন করতে বছরের প্রায় প্রতি তিন দিনে এক দিন কোনো না কোনো সংশোধনীর বর্ষপূর্তি হবে। সে তুলনায় আমাদের সংশোধনী সাকুল্যে ১৫টি। তার মধ্যে বিভিন্নভাবে চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, ১১তম, ১৩তম বাতিল হয়ে গেছে। বাকি থাকে ১০টি সংশোধনী। ১০টার মধ্যে দুটি, অর্থাৎ অষ্টম ও ১২তমের অংশবিশেষ বাতিল হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ (!) হয়েছে একটি সংশোধনীর। অর্থাৎ ১০ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩০টিতে উন্নীত করা হয় ১০ বছরের জন্য। এই ১০ম সংশোধনীটা ১৯৯০ সালের। পরে মেয়াদোত্তীর্ণ এই ৩০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ১৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৫টিতে উন্নীত করা হয় ২০০৪ সালে। ১৫তম সংশোধনীর বদৌলতে আবার সংশোধিত হয়ে মহিলা আসনের সংখ্যা এখন ৫০। অর্থাৎ ১০ম সংশোধনীটিও এখন বেকার।
রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিসংক্রান্ত ও আনুষঙ্গিক ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যবস্থাপত্র ছিল ৬ ও ৯ নম্বর সংশোধনীতে। যেহেতু রাষ্ট্রপতিশাসিত নির্বাহী ব্যবস্থা দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে, ষষ্ঠ ও নবম সংশোধনীও এখন অচল! অর্থাৎ কোনো প্রয়োগ নেই।
এত সব হিসাব-নিকাশ করে পেলামটা কী? যদিও সংশোধনী হয়েছে ১৫টি, তবু টিকে আছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টমের অংশবিশেষ (রাষ্ট্রধর্ম অংশটি), দ্বাদশ, চতুর্দশের অংশবিশেষ (বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর) আর আজকের বর্ষপূর্তির পঞ্চদশ সংশোধনীটি।
অর্থাৎ বেশির ভাগ সংশোধনী সংবিধান নিয়ে কারণে-অকারণে-বেকারণে টানাহেঁচড়া করার জবরদস্ত সংস্কৃতিতে অক্কা পেয়েছে। বহাল তবিয়তে টিকে আছে কুল্লে পাঁচটি—প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ১২তম ও ১৫তম। আরও দু-চারটি, একটু আগেই উল্লেখ করেছি, আংশিকভাবে টিকে আছে।
এইতক এসে আশঙ্কা করছি, পাঠককুল হয়তো ভাবছেন, ব্যাটা এ লেখাটা কোন পানে (অর্থাৎ দিকে!) নিচ্ছে, এবং পড়াটা শেষ করবেন কি না। তাই লেখার মতলবটা সাত-জলদি ফাঁস করে দিই, যাতে পাঠক আরেকটু এগিয়ে যান, পড়তে পড়তে।
সংবিধানের আজকের বর্ষপূর্তির পঞ্চদশ সংশোধনীটি বিদ্যমান সংশোধনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।
২.
১৫টি সংশোধনীর সব কয়টি আমলে নিলে নিকৃষ্টতম হবে চতুর্থ সংশোধনী। সেটি যেহেতু এখন আর নেই, তাই নিকৃষ্টতম সংশোধনীর স্থান এখন পঞ্চদশ সংশোধনীর।
অবশ্য পঞ্চম আর সপ্তম সংশোধনীর ব্যাপারে বলা দরকার যে উর্দিপরা সেনাপতিরা যে সংবিধানকে শ্রদ্ধা করবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য। তাঁদের অপকর্ম অর্থাৎ সংবিধানকে পদদলিত করে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে দেশ শাসন করা—এটা তো সভ্য জগতের কাজ নয়। আর তাই সভ্য জগতের মাপকাঠি দিয়ে সবাইকে মূল্যায়ন করা অযৌক্তিক।
অর্থাৎ পঞ্চম ও সপ্তমকে সংবিধান সংশোধন না বলে সাংবিধানিক যথেচ্ছাচার বলাই শ্রেয়। যারা এ ধরনের কাজ করতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে তো মানুষের তুলনা চলে না। তবে একজন সামরিক শাসক এখনো আমাদের অন্যতম প্রধান গণতান্ত্রিক নেতা। গণতান্ত্রিক সরকারের দোসর। অবশ্য ভোল পাল্টে তিনি যেকোনো সময় অন্য গণতান্ত্রিক দলেরও দোস্ত হয়ে যেতে পারেন। আমাদের গণতন্ত্রে সামরিক শাসনের আর স্থান না থাকতে পারে, তবে সামরিক শাসকেরা যে কত গণতান্ত্রিক, তা সহজেই টের পাওয়া যায়। সামরিক শাসকের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অচলপ্রায়। আর সামরিক কর্তাব্যক্তিদের গুরুত্ব যে কত মহিমান্বিত, তার বহিঃপ্রকাশ দেখি যখন ছেলের বিয়ে যাতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, সে জন্য সেনাপ্রধানের ‘শাসনামল’ বৃদ্ধি করা হয়। গণতন্ত্রের মধ্যে সামন্তবাদী চিন্তা কত প্রকট হলে দেশের সেনাপ্রধানের ‘শাসনামল’ তাঁর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের অছিলায় বাড়ানো যায়!
বলা বাহুল্য, কথায় আর কাজে মিল না থাকাটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য। তাই সামরিক আইনকে যতই গালমন্দ করা হোক না, সামরিক শাসকদের ওপর নির্ভরশীলতা, সেনাপ্রধানকে তুষ্ট রাখার সব নিয়মকানুন জলাঞ্জলি দেওয়া—সবই আমাদের গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।
চতুর্থ সংশোধনীতে ফিরে আসি। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম সংসদ নির্বাচন হয়। সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে। তার অনেক আগে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে সংসদ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করল। সেই চতুর্থ সংশোধনী আইনের ৩৩ ধারায় বলা হয় যে সেই সংসদ অর্থাৎ যে সংসদ ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে নির্বাচিত হয়ে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধন আইন পাস করল, সেই সংসদ ‘...এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হইলে ভাঙ্গিয়া যাইবে।’
নির্বাচন-টির্বাচনের ঝুটঝামেলা নেই, সংসদ সংবিধান সংশোধন করে নিজের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার স্বর্ণোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বর্তমান সংসদের কোনো সাংসদ যদি পুনর্নির্বাচনের ব্যাপারে শঙ্কায় থাকেন, তাহলে চতুর্থ সংশোধনীর এই মহৎ বাঞ্ছাটা পুনঃপ্রবর্তনের ব্যাপারটা বিবেচনা শুরু করতে পারেন।
চতুর্থ সংশোধনীতে সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি কীভাবে নির্বাচিত হবেন, তার বিধান করা হয়। সে সময় দেশে একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন—এখনকার মতো সংসদীয় ব্যবস্থায় সীমিত ক্ষমতার রাষ্ট্রপতি। চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা চালু করে, সেই সংশোধনী আইনে বলা হলো:
ক) যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং
খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন।’
চতুর্থ সংশোধনী থেকে আর উদাহরণ টানছি না। খামোখা কার মাথায় কোন বুদ্ধি ঢুকে যায়।
৩.
পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে এখন সংবিধানের ৪ক অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ...সকল সরকারি, আধা সরকারি অফিসে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।’
পৃথিবীর অন্তত ৪০টা দেশের স্ব স্ব দেশ কর্তৃক স্বীকৃত জাতির জনক বা পিতা আছেন।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তাঁরা সবাই নিজ নিজ দেশের সর্বজনস্বীকৃত সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম নেতা। কিন্তু কোনো দেশের সংবিধানে তাদের দেশের জনক উল্লেখ খুঁজে পাইনি আজতক।
বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের প্রতিটির সংবিধান এই অধম তন্নতন্ন করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁজিনি, কেউ যদি সাহায্য করেন, তাহলে বাধিত হব, কৃতজ্ঞ হব। অর্থাৎ কোনো দেশের সংবিধানে সেই দেশের জাতির পিতার প্রতিকৃতি ও ভাষণের খোঁজ যদি পান, তাহলে তা জানালে বাধিত হব।
একইভাবে কোন সংবিধানে বক্তৃতা যুক্ত হয়েছে বা বক্তৃতা সংবিধানের অংশ, এমন কোনো সংবিধানের কথা অধমের জানা নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর বদৌলতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা এখন সংবিধানের পঞ্চম তফসিল।
রাজনৈতিক বক্তৃতা হিসেবে, বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ক্রান্তিকালে এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা হিসেবে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার স্থান নিয়ে কোনো বিতর্ক বা দ্বিমতের অবকাশ নেই। রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে বক্তৃতা লেখা থাকবে। মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তৃতাটি শুনলে এখনো চোখে পানি আসে। ১৯৬৩ সালের ওই বক্তৃতা মার্কিন সমাজে বহু যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু তাই বলে সেই বক্তৃতা তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অংশ হয়নি। শ্রদ্ধেয় মাহমুদুল ইসলাম সাহেব তাঁর বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন (বইটা ইংরেজিতে) বইটির গত মাসে প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণে এ কথাই বলেছেন। অর্থাৎ সংবিধানে বক্তৃতা কেন এবং পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা সংবিধানে নতুন ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে। ৭ক-এর মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগে অসাংবিধানিক পন্থায় কিছু করাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলা হয়েছে। আর ৭খ-তে যা বলা হয়েছে তার অর্থ হলো, সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কোনো সময় বা কোনো অবস্থায়ই আর সংশোধন করা যাবে না। অর্থাৎ সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদগুলোকে তথাকথিত ‘চিরস্থায়ী’ করা হয়েছে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একটা ব্রিটিশরা করেছিল ১৭৯৩ সালে। আমাদের ইতিহাসে দ্বিতীয় চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তন করল বর্তমান নবম সংসদ। বাহ্, বেশ!
৭ক আর ৭খ অসাংবিধানিক ঘোষণা করার মামলার আরজি আইনের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরাই লিখতে পারবে। আরজির একটা প্রধান যুক্তি হবে এই যে বর্তমান নবম সংসদ ভবিষ্যতের অর্থাৎ দশম বা একাদশ সংসদের ক্ষমতা সীমিত করতে বা কেড়ে নিতে পারে না। অর্থাৎ পরের কোনো সংসদ সংবিধানের অমুক অমুক অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে পারবে না, সেটা এই সংসদ বলতে পারবে না।
মুখে মুখে ১৯৭২-এ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা এত ঘন ঘন বলা হয়েছে যে শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৭২-এর সংবিধানের অনেক ভালো বিধান, যেমন অত্যন্ত সীমিত কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথক্করণ ও স্বাধীনতা, অনির্বাচিত ব্যক্তির ছয় মাসের বেশি মন্ত্রিত্ব না থাকা। (বলা বাহুল্য, সেই বিধান ফিরিয়ে আনলে বর্তমান আইনমন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব ২০১২ সালের ২ জানুয়ারিতে শেষ হতো) ইত্যাদি ঊহ্য থেকে গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলোপ করে দেশে যে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা অতীতের কোনো সংবিধান সংশোধন অর্জন করতে পারেনি। পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করার জন্য অন্তর্বর্তী নামক একটা সরকার আবিষ্কার করা হয়েছে। সেটা কী, তা সংবিধানে বলা নেই।
আইন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা না করা আর দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া—এই দুইয়ের সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধন। অবশ্য অতীতেও আমাদের বেশির ভাগ সংবিধান সংশোধনীর মূলে ছিল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থ।
তবে সংবিধান স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার নয়। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অর্জন। যারা এটাকে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে, তারাই পরাজিত হয়েছে। চতুর্দশ সংশোধনী করে বিএনপি ভেবেছিল, আবার নির্বাচনে জেতার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে ষোড়শ সংশোধনী হলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা থাকতেও পারে। তবে পঞ্চদশ সংশোধনী নির্বাচন পর্যন্ত অসংশোধিত থাকলে সংশোধনটা করবে অন্য দল। অর্থাৎ সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা পেয়ে যেতে পারে।
ড. শাহ্দীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, পরিচালক স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
আমরা সচরাচর কোনো সাফল্য বা বেদনার বর্ষপূর্তি পালন করি। সংবিধানের সংশোধনী বর্ষপূর্তি পালনের মতো জাতীয়ভাবে তেমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। পার্শ্ববর্তী ভারতের প্রতিটি সংবিধান সংশোধনীর বর্ষপূর্তি পালন করতে বছরের প্রায় প্রতি তিন দিনে এক দিন কোনো না কোনো সংশোধনীর বর্ষপূর্তি হবে। সে তুলনায় আমাদের সংশোধনী সাকুল্যে ১৫টি। তার মধ্যে বিভিন্নভাবে চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, ১১তম, ১৩তম বাতিল হয়ে গেছে। বাকি থাকে ১০টি সংশোধনী। ১০টার মধ্যে দুটি, অর্থাৎ অষ্টম ও ১২তমের অংশবিশেষ বাতিল হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ (!) হয়েছে একটি সংশোধনীর। অর্থাৎ ১০ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩০টিতে উন্নীত করা হয় ১০ বছরের জন্য। এই ১০ম সংশোধনীটা ১৯৯০ সালের। পরে মেয়াদোত্তীর্ণ এই ৩০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ১৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৫টিতে উন্নীত করা হয় ২০০৪ সালে। ১৫তম সংশোধনীর বদৌলতে আবার সংশোধিত হয়ে মহিলা আসনের সংখ্যা এখন ৫০। অর্থাৎ ১০ম সংশোধনীটিও এখন বেকার।
রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিসংক্রান্ত ও আনুষঙ্গিক ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যবস্থাপত্র ছিল ৬ ও ৯ নম্বর সংশোধনীতে। যেহেতু রাষ্ট্রপতিশাসিত নির্বাহী ব্যবস্থা দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে, ষষ্ঠ ও নবম সংশোধনীও এখন অচল! অর্থাৎ কোনো প্রয়োগ নেই।
এত সব হিসাব-নিকাশ করে পেলামটা কী? যদিও সংশোধনী হয়েছে ১৫টি, তবু টিকে আছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টমের অংশবিশেষ (রাষ্ট্রধর্ম অংশটি), দ্বাদশ, চতুর্দশের অংশবিশেষ (বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর) আর আজকের বর্ষপূর্তির পঞ্চদশ সংশোধনীটি।
অর্থাৎ বেশির ভাগ সংশোধনী সংবিধান নিয়ে কারণে-অকারণে-বেকারণে টানাহেঁচড়া করার জবরদস্ত সংস্কৃতিতে অক্কা পেয়েছে। বহাল তবিয়তে টিকে আছে কুল্লে পাঁচটি—প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ১২তম ও ১৫তম। আরও দু-চারটি, একটু আগেই উল্লেখ করেছি, আংশিকভাবে টিকে আছে।
এইতক এসে আশঙ্কা করছি, পাঠককুল হয়তো ভাবছেন, ব্যাটা এ লেখাটা কোন পানে (অর্থাৎ দিকে!) নিচ্ছে, এবং পড়াটা শেষ করবেন কি না। তাই লেখার মতলবটা সাত-জলদি ফাঁস করে দিই, যাতে পাঠক আরেকটু এগিয়ে যান, পড়তে পড়তে।
সংবিধানের আজকের বর্ষপূর্তির পঞ্চদশ সংশোধনীটি বিদ্যমান সংশোধনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।
২.
১৫টি সংশোধনীর সব কয়টি আমলে নিলে নিকৃষ্টতম হবে চতুর্থ সংশোধনী। সেটি যেহেতু এখন আর নেই, তাই নিকৃষ্টতম সংশোধনীর স্থান এখন পঞ্চদশ সংশোধনীর।
অবশ্য পঞ্চম আর সপ্তম সংশোধনীর ব্যাপারে বলা দরকার যে উর্দিপরা সেনাপতিরা যে সংবিধানকে শ্রদ্ধা করবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য। তাঁদের অপকর্ম অর্থাৎ সংবিধানকে পদদলিত করে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে দেশ শাসন করা—এটা তো সভ্য জগতের কাজ নয়। আর তাই সভ্য জগতের মাপকাঠি দিয়ে সবাইকে মূল্যায়ন করা অযৌক্তিক।
অর্থাৎ পঞ্চম ও সপ্তমকে সংবিধান সংশোধন না বলে সাংবিধানিক যথেচ্ছাচার বলাই শ্রেয়। যারা এ ধরনের কাজ করতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে তো মানুষের তুলনা চলে না। তবে একজন সামরিক শাসক এখনো আমাদের অন্যতম প্রধান গণতান্ত্রিক নেতা। গণতান্ত্রিক সরকারের দোসর। অবশ্য ভোল পাল্টে তিনি যেকোনো সময় অন্য গণতান্ত্রিক দলেরও দোস্ত হয়ে যেতে পারেন। আমাদের গণতন্ত্রে সামরিক শাসনের আর স্থান না থাকতে পারে, তবে সামরিক শাসকেরা যে কত গণতান্ত্রিক, তা সহজেই টের পাওয়া যায়। সামরিক শাসকের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অচলপ্রায়। আর সামরিক কর্তাব্যক্তিদের গুরুত্ব যে কত মহিমান্বিত, তার বহিঃপ্রকাশ দেখি যখন ছেলের বিয়ে যাতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, সে জন্য সেনাপ্রধানের ‘শাসনামল’ বৃদ্ধি করা হয়। গণতন্ত্রের মধ্যে সামন্তবাদী চিন্তা কত প্রকট হলে দেশের সেনাপ্রধানের ‘শাসনামল’ তাঁর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের অছিলায় বাড়ানো যায়!
বলা বাহুল্য, কথায় আর কাজে মিল না থাকাটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য। তাই সামরিক আইনকে যতই গালমন্দ করা হোক না, সামরিক শাসকদের ওপর নির্ভরশীলতা, সেনাপ্রধানকে তুষ্ট রাখার সব নিয়মকানুন জলাঞ্জলি দেওয়া—সবই আমাদের গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।
চতুর্থ সংশোধনীতে ফিরে আসি। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম সংসদ নির্বাচন হয়। সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে। তার অনেক আগে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে সংসদ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করল। সেই চতুর্থ সংশোধনী আইনের ৩৩ ধারায় বলা হয় যে সেই সংসদ অর্থাৎ যে সংসদ ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে নির্বাচিত হয়ে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধন আইন পাস করল, সেই সংসদ ‘...এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হইলে ভাঙ্গিয়া যাইবে।’
নির্বাচন-টির্বাচনের ঝুটঝামেলা নেই, সংসদ সংবিধান সংশোধন করে নিজের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার স্বর্ণোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বর্তমান সংসদের কোনো সাংসদ যদি পুনর্নির্বাচনের ব্যাপারে শঙ্কায় থাকেন, তাহলে চতুর্থ সংশোধনীর এই মহৎ বাঞ্ছাটা পুনঃপ্রবর্তনের ব্যাপারটা বিবেচনা শুরু করতে পারেন।
চতুর্থ সংশোধনীতে সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি কীভাবে নির্বাচিত হবেন, তার বিধান করা হয়। সে সময় দেশে একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন—এখনকার মতো সংসদীয় ব্যবস্থায় সীমিত ক্ষমতার রাষ্ট্রপতি। চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা চালু করে, সেই সংশোধনী আইনে বলা হলো:
ক) যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং
খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন।’
চতুর্থ সংশোধনী থেকে আর উদাহরণ টানছি না। খামোখা কার মাথায় কোন বুদ্ধি ঢুকে যায়।
৩.
পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে এখন সংবিধানের ৪ক অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ...সকল সরকারি, আধা সরকারি অফিসে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।’
পৃথিবীর অন্তত ৪০টা দেশের স্ব স্ব দেশ কর্তৃক স্বীকৃত জাতির জনক বা পিতা আছেন।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তাঁরা সবাই নিজ নিজ দেশের সর্বজনস্বীকৃত সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম নেতা। কিন্তু কোনো দেশের সংবিধানে তাদের দেশের জনক উল্লেখ খুঁজে পাইনি আজতক।
বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের প্রতিটির সংবিধান এই অধম তন্নতন্ন করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁজিনি, কেউ যদি সাহায্য করেন, তাহলে বাধিত হব, কৃতজ্ঞ হব। অর্থাৎ কোনো দেশের সংবিধানে সেই দেশের জাতির পিতার প্রতিকৃতি ও ভাষণের খোঁজ যদি পান, তাহলে তা জানালে বাধিত হব।
একইভাবে কোন সংবিধানে বক্তৃতা যুক্ত হয়েছে বা বক্তৃতা সংবিধানের অংশ, এমন কোনো সংবিধানের কথা অধমের জানা নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর বদৌলতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা এখন সংবিধানের পঞ্চম তফসিল।
রাজনৈতিক বক্তৃতা হিসেবে, বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ক্রান্তিকালে এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা হিসেবে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার স্থান নিয়ে কোনো বিতর্ক বা দ্বিমতের অবকাশ নেই। রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে বক্তৃতা লেখা থাকবে। মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তৃতাটি শুনলে এখনো চোখে পানি আসে। ১৯৬৩ সালের ওই বক্তৃতা মার্কিন সমাজে বহু যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু তাই বলে সেই বক্তৃতা তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অংশ হয়নি। শ্রদ্ধেয় মাহমুদুল ইসলাম সাহেব তাঁর বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন (বইটা ইংরেজিতে) বইটির গত মাসে প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণে এ কথাই বলেছেন। অর্থাৎ সংবিধানে বক্তৃতা কেন এবং পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা সংবিধানে নতুন ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে। ৭ক-এর মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগে অসাংবিধানিক পন্থায় কিছু করাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলা হয়েছে। আর ৭খ-তে যা বলা হয়েছে তার অর্থ হলো, সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কোনো সময় বা কোনো অবস্থায়ই আর সংশোধন করা যাবে না। অর্থাৎ সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদগুলোকে তথাকথিত ‘চিরস্থায়ী’ করা হয়েছে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একটা ব্রিটিশরা করেছিল ১৭৯৩ সালে। আমাদের ইতিহাসে দ্বিতীয় চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তন করল বর্তমান নবম সংসদ। বাহ্, বেশ!
৭ক আর ৭খ অসাংবিধানিক ঘোষণা করার মামলার আরজি আইনের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরাই লিখতে পারবে। আরজির একটা প্রধান যুক্তি হবে এই যে বর্তমান নবম সংসদ ভবিষ্যতের অর্থাৎ দশম বা একাদশ সংসদের ক্ষমতা সীমিত করতে বা কেড়ে নিতে পারে না। অর্থাৎ পরের কোনো সংসদ সংবিধানের অমুক অমুক অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে পারবে না, সেটা এই সংসদ বলতে পারবে না।
মুখে মুখে ১৯৭২-এ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা এত ঘন ঘন বলা হয়েছে যে শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৭২-এর সংবিধানের অনেক ভালো বিধান, যেমন অত্যন্ত সীমিত কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথক্করণ ও স্বাধীনতা, অনির্বাচিত ব্যক্তির ছয় মাসের বেশি মন্ত্রিত্ব না থাকা। (বলা বাহুল্য, সেই বিধান ফিরিয়ে আনলে বর্তমান আইনমন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব ২০১২ সালের ২ জানুয়ারিতে শেষ হতো) ইত্যাদি ঊহ্য থেকে গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলোপ করে দেশে যে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা অতীতের কোনো সংবিধান সংশোধন অর্জন করতে পারেনি। পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করার জন্য অন্তর্বর্তী নামক একটা সরকার আবিষ্কার করা হয়েছে। সেটা কী, তা সংবিধানে বলা নেই।
আইন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা না করা আর দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া—এই দুইয়ের সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধন। অবশ্য অতীতেও আমাদের বেশির ভাগ সংবিধান সংশোধনীর মূলে ছিল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থ।
তবে সংবিধান স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার নয়। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অর্জন। যারা এটাকে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে, তারাই পরাজিত হয়েছে। চতুর্দশ সংশোধনী করে বিএনপি ভেবেছিল, আবার নির্বাচনে জেতার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে ষোড়শ সংশোধনী হলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা থাকতেও পারে। তবে পঞ্চদশ সংশোধনী নির্বাচন পর্যন্ত অসংশোধিত থাকলে সংশোধনটা করবে অন্য দল। অর্থাৎ সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা পেয়ে যেতে পারে।
ড. শাহ্দীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, পরিচালক স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।