মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

পঞ্চদশ সংশোধনী: উৎকটতার বর্ষপূর্তি


শাহ্দীন মালিক

গত বছর, ২০১১ সালের ৩ জুলাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদ পাস করেছিল। ক্যালেন্ডারের হিসাবে আজ প্রথম বর্ষপূর্তি।
আমরা সচরাচর কোনো সাফল্য বা বেদনার বর্ষপূর্তি পালন করি। সংবিধানের সংশোধনী বর্ষপূর্তি পালনের মতো জাতীয়ভাবে তেমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। পার্শ্ববর্তী ভারতের প্রতিটি সংবিধান সংশোধনীর বর্ষপূর্তি পালন করতে বছরের প্রায় প্রতি তিন দিনে এক দিন কোনো না কোনো সংশোধনীর বর্ষপূর্তি হবে। সে তুলনায় আমাদের সংশোধনী সাকুল্যে ১৫টি। তার মধ্যে বিভিন্নভাবে চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, ১১তম, ১৩তম বাতিল হয়ে গেছে। বাকি থাকে ১০টি সংশোধনী। ১০টার মধ্যে দুটি, অর্থাৎ অষ্টম ও ১২তমের অংশবিশেষ বাতিল হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ (!) হয়েছে একটি সংশোধনীর। অর্থাৎ ১০ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩০টিতে উন্নীত করা হয় ১০ বছরের জন্য। এই ১০ম সংশোধনীটা ১৯৯০ সালের। পরে মেয়াদোত্তীর্ণ এই ৩০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ১৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৫টিতে উন্নীত করা হয় ২০০৪ সালে। ১৫তম সংশোধনীর বদৌলতে আবার সংশোধিত হয়ে মহিলা আসনের সংখ্যা এখন ৫০। অর্থাৎ ১০ম সংশোধনীটিও এখন বেকার।
রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিসংক্রান্ত ও আনুষঙ্গিক ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যবস্থাপত্র ছিল ৬ ও ৯ নম্বর সংশোধনীতে। যেহেতু রাষ্ট্রপতিশাসিত নির্বাহী ব্যবস্থা দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে, ষষ্ঠ ও নবম সংশোধনীও এখন অচল! অর্থাৎ কোনো প্রয়োগ নেই।
এত সব হিসাব-নিকাশ করে পেলামটা কী? যদিও সংশোধনী হয়েছে ১৫টি, তবু টিকে আছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টমের অংশবিশেষ (রাষ্ট্রধর্ম অংশটি), দ্বাদশ, চতুর্দশের অংশবিশেষ (বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর) আর আজকের বর্ষপূর্তির পঞ্চদশ সংশোধনীটি।
অর্থাৎ বেশির ভাগ সংশোধনী সংবিধান নিয়ে কারণে-অকারণে-বেকারণে টানাহেঁচড়া করার জবরদস্ত সংস্কৃতিতে অক্কা পেয়েছে। বহাল তবিয়তে টিকে আছে কুল্লে পাঁচটি—প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ১২তম ও ১৫তম। আরও দু-চারটি, একটু আগেই উল্লেখ করেছি, আংশিকভাবে টিকে আছে।
এইতক এসে আশঙ্কা করছি, পাঠককুল হয়তো ভাবছেন, ব্যাটা এ লেখাটা কোন পানে (অর্থাৎ দিকে!) নিচ্ছে, এবং পড়াটা শেষ করবেন কি না। তাই লেখার মতলবটা সাত-জলদি ফাঁস করে দিই, যাতে পাঠক আরেকটু এগিয়ে যান, পড়তে পড়তে।
সংবিধানের আজকের বর্ষপূর্তির পঞ্চদশ সংশোধনীটি বিদ্যমান সংশোধনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।

২.
১৫টি সংশোধনীর সব কয়টি আমলে নিলে নিকৃষ্টতম হবে চতুর্থ সংশোধনী। সেটি যেহেতু এখন আর নেই, তাই নিকৃষ্টতম সংশোধনীর স্থান এখন পঞ্চদশ সংশোধনীর।
অবশ্য পঞ্চম আর সপ্তম সংশোধনীর ব্যাপারে বলা দরকার যে উর্দিপরা সেনাপতিরা যে সংবিধানকে শ্রদ্ধা করবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য। তাঁদের অপকর্ম অর্থাৎ সংবিধানকে পদদলিত করে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে দেশ শাসন করা—এটা তো সভ্য জগতের কাজ নয়। আর তাই সভ্য জগতের মাপকাঠি দিয়ে সবাইকে মূল্যায়ন করা অযৌক্তিক।
অর্থাৎ পঞ্চম ও সপ্তমকে সংবিধান সংশোধন না বলে সাংবিধানিক যথেচ্ছাচার বলাই শ্রেয়। যারা এ ধরনের কাজ করতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে তো মানুষের তুলনা চলে না। তবে একজন সামরিক শাসক এখনো আমাদের অন্যতম প্রধান গণতান্ত্রিক নেতা। গণতান্ত্রিক সরকারের দোসর। অবশ্য ভোল পাল্টে তিনি যেকোনো সময় অন্য গণতান্ত্রিক দলেরও দোস্ত হয়ে যেতে পারেন। আমাদের গণতন্ত্রে সামরিক শাসনের আর স্থান না থাকতে পারে, তবে সামরিক শাসকেরা যে কত গণতান্ত্রিক, তা সহজেই টের পাওয়া যায়। সামরিক শাসকের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অচলপ্রায়। আর সামরিক কর্তাব্যক্তিদের গুরুত্ব যে কত মহিমান্বিত, তার বহিঃপ্রকাশ দেখি যখন ছেলের বিয়ে যাতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, সে জন্য সেনাপ্রধানের ‘শাসনামল’ বৃদ্ধি করা হয়। গণতন্ত্রের মধ্যে সামন্তবাদী চিন্তা কত প্রকট হলে দেশের সেনাপ্রধানের ‘শাসনামল’ তাঁর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের অছিলায় বাড়ানো যায়!
বলা বাহুল্য, কথায় আর কাজে মিল না থাকাটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য। তাই সামরিক আইনকে যতই গালমন্দ করা হোক না, সামরিক শাসকদের ওপর নির্ভরশীলতা, সেনাপ্রধানকে তুষ্ট রাখার সব নিয়মকানুন জলাঞ্জলি দেওয়া—সবই আমাদের গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।
চতুর্থ সংশোধনীতে ফিরে আসি। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম সংসদ নির্বাচন হয়। সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে। তার অনেক আগে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে সংসদ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করল। সেই চতুর্থ সংশোধনী আইনের ৩৩ ধারায় বলা হয় যে সেই সংসদ অর্থাৎ যে সংসদ ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে নির্বাচিত হয়ে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধন আইন পাস করল, সেই সংসদ ‘...এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হইলে ভাঙ্গিয়া যাইবে।’
নির্বাচন-টির্বাচনের ঝুটঝামেলা নেই, সংসদ সংবিধান সংশোধন করে নিজের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার স্বর্ণোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বর্তমান সংসদের কোনো সাংসদ যদি পুনর্নির্বাচনের ব্যাপারে শঙ্কায় থাকেন, তাহলে চতুর্থ সংশোধনীর এই মহৎ বাঞ্ছাটা পুনঃপ্রবর্তনের ব্যাপারটা বিবেচনা শুরু করতে পারেন।
চতুর্থ সংশোধনীতে সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি কীভাবে নির্বাচিত হবেন, তার বিধান করা হয়। সে সময় দেশে একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন—এখনকার মতো সংসদীয় ব্যবস্থায় সীমিত ক্ষমতার রাষ্ট্রপতি। চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা চালু করে, সেই সংশোধনী আইনে বলা হলো: 
ক) যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং 
খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন।’ 
চতুর্থ সংশোধনী থেকে আর উদাহরণ টানছি না। খামোখা কার মাথায় কোন বুদ্ধি ঢুকে যায়।

৩.
পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে এখন সংবিধানের ৪ক অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ...সকল সরকারি, আধা সরকারি অফিসে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।’ 
পৃথিবীর অন্তত ৪০টা দেশের স্ব স্ব দেশ কর্তৃক স্বীকৃত জাতির জনক বা পিতা আছেন। 
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তাঁরা সবাই নিজ নিজ দেশের সর্বজনস্বীকৃত সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম নেতা। কিন্তু কোনো দেশের সংবিধানে তাদের দেশের জনক উল্লেখ খুঁজে পাইনি আজতক। 
বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের প্রতিটির সংবিধান এই অধম তন্নতন্ন করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁজিনি, কেউ যদি সাহায্য করেন, তাহলে বাধিত হব, কৃতজ্ঞ হব। অর্থাৎ কোনো দেশের সংবিধানে সেই দেশের জাতির পিতার প্রতিকৃতি ও ভাষণের খোঁজ যদি পান, তাহলে তা জানালে বাধিত হব। 
একইভাবে কোন সংবিধানে বক্তৃতা যুক্ত হয়েছে বা বক্তৃতা সংবিধানের অংশ, এমন কোনো সংবিধানের কথা অধমের জানা নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর বদৌলতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা এখন সংবিধানের পঞ্চম তফসিল। 
রাজনৈতিক বক্তৃতা হিসেবে, বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ক্রান্তিকালে এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা হিসেবে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার স্থান নিয়ে কোনো বিতর্ক বা দ্বিমতের অবকাশ নেই। রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে বক্তৃতা লেখা থাকবে। মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তৃতাটি শুনলে এখনো চোখে পানি আসে। ১৯৬৩ সালের ওই বক্তৃতা মার্কিন সমাজে বহু যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু তাই বলে সেই বক্তৃতা তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অংশ হয়নি। শ্রদ্ধেয় মাহমুদুল ইসলাম সাহেব তাঁর বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন (বইটা ইংরেজিতে) বইটির গত মাসে প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণে এ কথাই বলেছেন। অর্থাৎ সংবিধানে বক্তৃতা কেন এবং পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা সংবিধানে নতুন ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে। ৭ক-এর মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগে অসাংবিধানিক পন্থায় কিছু করাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলা হয়েছে। আর ৭খ-তে যা বলা হয়েছে তার অর্থ হলো, সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কোনো সময় বা কোনো অবস্থায়ই আর সংশোধন করা যাবে না। অর্থাৎ সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদগুলোকে তথাকথিত ‘চিরস্থায়ী’ করা হয়েছে। 
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একটা ব্রিটিশরা করেছিল ১৭৯৩ সালে। আমাদের ইতিহাসে দ্বিতীয় চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তন করল বর্তমান নবম সংসদ। বাহ্, বেশ! 
৭ক আর ৭খ অসাংবিধানিক ঘোষণা করার মামলার আরজি আইনের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরাই লিখতে পারবে। আরজির একটা প্রধান যুক্তি হবে এই যে বর্তমান নবম সংসদ ভবিষ্যতের অর্থাৎ দশম বা একাদশ সংসদের ক্ষমতা সীমিত করতে বা কেড়ে নিতে পারে না। অর্থাৎ পরের কোনো সংসদ সংবিধানের অমুক অমুক অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে পারবে না, সেটা এই সংসদ বলতে পারবে না। 
মুখে মুখে ১৯৭২-এ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা এত ঘন ঘন বলা হয়েছে যে শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৭২-এর সংবিধানের অনেক ভালো বিধান, যেমন অত্যন্ত সীমিত কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথক্করণ ও স্বাধীনতা, অনির্বাচিত ব্যক্তির ছয় মাসের বেশি মন্ত্রিত্ব না থাকা। (বলা বাহুল্য, সেই বিধান ফিরিয়ে আনলে বর্তমান আইনমন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব ২০১২ সালের ২ জানুয়ারিতে শেষ হতো) ইত্যাদি ঊহ্য থেকে গেছে। 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলোপ করে দেশে যে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা অতীতের কোনো সংবিধান সংশোধন অর্জন করতে পারেনি। পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করার জন্য অন্তর্বর্তী নামক একটা সরকার আবিষ্কার করা হয়েছে। সেটা কী, তা সংবিধানে বলা নেই। 
আইন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা না করা আর দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া—এই দুইয়ের সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধন। অবশ্য অতীতেও আমাদের বেশির ভাগ সংবিধান সংশোধনীর মূলে ছিল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থ। 
তবে সংবিধান স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার নয়। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অর্জন। যারা এটাকে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে, তারাই পরাজিত হয়েছে। চতুর্দশ সংশোধনী করে বিএনপি ভেবেছিল, আবার নির্বাচনে জেতার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে ষোড়শ সংশোধনী হলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা থাকতেও পারে। তবে পঞ্চদশ সংশোধনী নির্বাচন পর্যন্ত অসংশোধিত থাকলে সংশোধনটা করবে অন্য দল। অর্থাৎ সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা পেয়ে যেতে পারে।
ড. শাহ্দীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, পরিচালক স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।

বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

ব্যবস্থা না নিলে দেশ গভীর সংকটে নিমজ্জিত হবে





সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকার পরিস্থিতির লঙ্ঘন হিসেবে বহুকাল ধরেই বিদ্যমান। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাংবিধানিক ও সর্বজনস্বীকৃত দায়িত্ব হলো, অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত সাপেক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ করে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করা এবং সংশ্লিষ্ট আদালতের দায়িত্ব নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে বিচার সম্পন্ন করা; অভিযুক্ত হলে সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করা। এ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন বছরের পর বছর একটি বা দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, শত শত নাগরিককে ধরে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে, তখন সেটা আইনের শাসন, সাংবিধানিক অধিকার ও সর্বজনীন মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন হয়ে দাঁড়ায়।
এ ধরনের শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারো কোনো বিচার না হওয়া; এসব হত্যাকাণ্ডের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমনকি প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি দাঁড় করিয়ে বক্তব্য দেওয়া এবং তৃতীয়ত যৌথ বাহিনীর দায়মুক্তি আইন, ২০০৩ (২০০৩ সালের ১ নম্বর আইন)-এর মতো আইন করার অর্থ হলো- যৌথ বাহিনী অর্থাৎ সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত সব অপরাধের সরাসরি দায়মুক্তি দেওয়া। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশ যে ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে এবং আমাদের দেশের সমালোচকের সংখ্যা যে দিন দিন বাড়ছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সাম্প্রতিককালে জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অতিসম্প্রতি জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য ও সমালোচনার যদি প্রতিবাদই করি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিচারব্যবস্থা ও দুর্নীতির ব্যাপারে অবিলম্বে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং ব্যবস্থা গ্রহণ না করি, তাহলে অচিরেই দেশ গভীর সংকটে নিমজ্জিত হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে পর্যাপ্ত অর্থ ও লোকবল দিয়ে শক্তিশালী না করাটাও সরকারের মানবাধিকার বিষয়ে উদাসীনতারই বহিঃপ্রকাশ।
ক্রমাগতভাবে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, দুর্বল আইন ও বিচার এবং দুর্নীতির ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি শ্লথ হওয়ার কারণে স্পষ্টত সরকারের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা বা তাঁদের পরিবারবর্গ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ। ১৬ কোটি মানুষ। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে চরম পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে সহিংসতার মধ্য দিয়ে, যা আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে দেখা যাচ্ছে- ভাঙচুর, সড়ক অবরোধ ও উচ্ছৃঙ্খলতার সঙ্গে জনগণের একটি বড় অংশ জড়িয়ে পড়ছে। এ সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরকার অবিলম্বে সত্যিকার অর্থে সক্রিয় হয়ে উঠবে- এটাই এখন দেশের মানুষ
প্রত্যাশা করছে।

বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

সরকারের বড় শত্রু—দুদক


সরকারকে হরহামেশা গালমন্দ করে নিজেই ক্লান্ত। তাই পণ করেছি, আজ সরকারের পক্ষে বলব।
এমনিতেই নীতি-দুর্নীতি নিয়ে আরও হাজারো নাগরিকের মতো অনেক ভাবনা মনের ভেতরে কোথাও না কোথাও ইতিপাতি, হাঁসফাঁস করছিল। প্রিয় লেখক আনিসুল হক দুর্নীতি নিয়ে প্রথম আলোতে তাঁর কলামের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘পুকুরচুরি বিলচুরি নদীচুরি’ (প্রথম আলো, ৫ জুন, ২০১২, পৃষ্ঠা ১২)। অর্থাৎ এক অর্থে শুধু টাকা-পয়সার আসল দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি নিয়ে চিন্তা, বক্তব্য লেখালেখি—সবকিছুই আমাদের আছে। দুর্নীতি আছে কিন্তু কথাবার্তা নেই অথবা শুধু কথাবার্তাই আছে আসল দুর্নীতি নেই—তাহলে তো ব্যাপারটা বেমানান বা জুতসই হতো না। দুর্নীতিকে সর্বাঙ্গীণ (অর্থাৎ লেখালেখির মাধ্যমে) করার প্রয়াসে তাই আবার শামিল হই। সর্বব্যাপী ব্যাপার। বাইরে থাকি কেমনে। তবে সমস্যা হলো, অধম আমলাও না, আর রাজনীতির ত্রিসীমানায়ও ঘেঁষতে অক্ষম। তাই আপাতত দুর্নীতির বিষয়ে অবদান প্রথম আলোর কলামেই সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে!
লেখাটি নিয়ে এগোনোর আগে একটু ‘সাইড-টক’। দুর্নীতি নিয়ে গান-কবিতা, কেন হচ্ছে না। দুর্নীতি তো সবাইকে এখন ‘টাচ’ করছে। আমাদের গীতিকার, গায়ক-গায়িকারা মনে হচ্ছে এ-জাতীয় ইস্যু নিয়ে মোটেও উদ্বেলিত হচ্ছেন না। বোধ হয় দুর্নীতি রস-কষ, প্রেম-ভালোবাসাবিহীন একটা শুকনো ব্যাপার।

২. 
সরকার নিশ্চয় আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়। চলমান পাঁচ বছরের কম-বেশি সাড়ে তিন বছর, অর্থাৎ শতকরা ৭০ ভাগ সময় পেরিয়ে গেছে। বাকি ৩০ ভাগ, দেখতে দেখতে মাস তিনেক পরে অঙ্কের হিসাবে বাকি থাকবে সাকল্যে এক-চতুর্থাংশ সময়। আবার আরও পাঁচ বছরের জন্য সরকারের ক্ষমতায় থাকতে হলে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা এখন থেকেই নিতে হবে, যাতে জনগণ আরও পাঁচ-পাঁচটি বছরের জন্য বর্তমান সরকারি জোটকে আবার ক্ষমতাসীন করেন। ভালো ভালো ব্যবস্থা এখন থেকেই নিতে হবে, নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। পুনর্নির্বাচিত হওয়া বা আরও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসার পথে যে বাধার সৃষ্টি করবে, সে নিশ্চয়ই বর্তমান দিনবদলের ডিজিটাল সরকারের বড় শত্রু। আশা করছি, অধমের শত্রুসংক্রান্ত এই মূল্যায়নের সঙ্গে চরম ও কট্টর সরকারপন্থীরা একমত হবেন। নিদেনপক্ষে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে অধমের পানে ধেয়ে আসবেন না। 
দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের ওয়েবসাইটে গেলে কত অভিযোগ পাওয়া গেছে, কতগুলোর তদন্ত হচ্ছে, এফআইআর এবং মামলা কত হয়েছে, কয়টি মামলা বিচারাধীন আছে—ইত্যাদি কিছু সংখ্যা পাওয়া যায়। যেটা আজকাল পত্রপত্রিকায় দেখি না, সেটা হলো দুর্নীতির দায়ে বিচার হয়ে শাস্তি হওয়ার খবর। দুদক অনেক তদন্ত করছে। সব তদন্ত তো আর পত্রিকাআলারা হেডলাইন করে না বা সংবাদমাধ্যম পাত্তা দেয় না। যেগুলো সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পারি সেগুলো নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ, অর্থাৎ যথার্থই সংবাদ হওয়ার যোগ্য। যেমন পদ্মা সেতুসংক্রান্ত দুর্নীতির কোনো ধরনের হদিস আমাদের দুদক পায়নি। ব্যাটা হতচ্ছাড়া বিশ্বব্যাংক। আমাদের ফুলের মতো পবিত্র রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে শুধু শুধু কুৎসা রটনা। অবশ্য বোধ হয় বিনা কারণে না। নিশ্চয় ঘোরতর আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দুর্নীতির এই দুর্নাম আমাদের মন্ত্রীদের সইতে হচ্ছে। আমার মনে হয়, সম্মানিত সাংসদেরা বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের বড় সাহেবকে এখন তলব করতে পারেন জবাবদিহি করার জন্য। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হোক—আমাদের স্বাধীন দক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো দুর্নীতি পেল না আজতক, আর আপনি কীভাবে পেলেন?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বেলায় একই হলো। মাঝরাতে ঢাকা শহরে কোথায় কোন একটা গাড়িতে কয়েক লাখ টাকা পাওয়া গেল। হ্যাঁ, গাড়ির আরোহীরা সেনগুপ্ত সাহেবের বেশ পরিচিত। মন্ত্রী হয়েছেন বলে কি সেনগুপ্ত সাহেবের টাকাওয়ালা পরিচিত কোনো ব্যক্তি থাকতে পারবেন না? না কি তাঁরা তাঁদের টাকা নিজের গাড়িতে করে ঘোরাঘুরি করতে পারবেন না। সঠিকভাবেই দুদক সুরঞ্জিত বাবুর দুর্নীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি।
আগেই বলেছি, দুদক খুব বেশি দুর্নীতি খুঁজে পাচ্ছে না। রিলিফের টিন, কাবিখার চাল-গম, ব্যাংকের ক্যাশিয়ারের ১০-২০ হাজার লোপাট করা—এসব সম্ভবত খুঁজে পেতে দুদক বেশ পটু। কিন্তু এ দেশের বর্তমানকালের কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তি যে দুর্নীতি করেন, তার প্রমাণ দুদকের কার্যকলাপে এখন আর পাওয়া যাবে না।
আরেকটা ‘সাইড টক’। গত ফেব্রুয়ারিতে খবরে পড়লাম, দুদকের দুজন কমিশনার তাঁদের মেয়াদ পূর্তিতে অবসরে গেছেন। দুদক আইন পড়ে দেখলাম, শুধু এক চেয়ারম্যান দিয়ে দুদক চলে না; সিদ্ধান্ত নিতে হবে চেয়ারম্যানসহ মোট তিন সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে। জনস্বার্থে ব্যস্ত বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠালাম। দুই কমিশনার ছাড়া দুদক চলতে পারে না। সঠিক দিনক্ষণ মনে নেই, তবে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানোর মাস খানেক পর দুজন নতুন কমিশনার নিয়োজিত হয়েছেন। চুপেচাপে যদিও দুদক আইনে নিয়োগ কমিটি আছে হরেক রকমের হর্তাকর্তার সমন্বয়ে।

৩.
দুদক দুর্নীতি খুঁজে পাচ্ছে না, তাহলে সরকারের বড় শত্রু হলো কীভাবে?
দেশের মানুষ তো ধারণা করে, সম্ভবত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করে, দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। আনিসুল হকের ভাষায়, পুকুরচুরি বিলচুরি নদীচুরি—সবই এন্তার হচ্ছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আবুলি সড়ক’ আর পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ভোটের সময় ভোটাররা মনে রাখবেন। দুদক যতই ক্লিন সার্টিফিকেট দিক না কেন, মধ্যরাতের ৭০ লাখ টাকা ভোটাররা ডার্টি মানি হিসেবেই মনে রাখবেন। ২০০৪ সালে দুদক গঠিত হওয়ার পর তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান আর মেম্বার-কমিশনাররা কার, কিসের ক্ষমতা, আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে রাখা হবে, কতজন ছাঁটাই হবে ইত্যাদি বড় বড় জটিল বিষয়ে এত বেশি ব্যস্ত ছিলেন যে হাওয়া ভবন বা বিএনপির আমলের কোনো দুর্নীতির ব্যাপারেই মনোযোগী হতে পারেননি।
সে সময় দুদক দু-চারজনকে ধরতে পারলে পরবর্তী সময়ে হাওয়া ভবন এবং ক্ষমতার আশপাশের ব্যক্তিদের দুর্নীতির পরিমাণ জানতে পেরে আমরা আঁতকে উঠতাম না। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সেই দুর্নীতি-জ্ঞানের প্রতিফলন হয়েছিল। অর্থাৎ বিএনপির আমলের বিকট দুর্নীতি ২০০৭-২০০৮-এর সরকারের আমলে ফাঁস হওয়া বিএনপির ভরাডুবির প্রধান কারণ ছিল। ২০০৪-২০০৬ সালে দুদক যদি কিছুটা হলেও সক্রিয় হতো আর রুই-কাতলা না হোক, নিদেনপক্ষে যদি কিছু পুঁটিমাছও ধরত, তাহলে বিএনপির এ ভরাডুবি হতো না।
তাই বলছিলাম, দুদক এখন সরকারের শত্রু। এটা ঠিক যে রুই-কাতলারা এখন বহাল তবিয়তে আছেন। দুদক তাঁদের বিরক্ত করছে না। আর তত্ত্বাবধায়ক আমলে বর্তমান সরকারের যেসব হোমরা-চোমরা দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মামলা আপিলে খারিজ অথবা বিচার শেষ না হওয়া মামলাগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে। আগের বা নতুন, কোনো মামলাই বলতে গেলে নেই। তাই বলে জনগণ কি ভাবছে যে দুর্নীতি হচ্ছে না? নিশ্চয় না। দুদক যদি দুই-চারজনকে ধরত, মামলা করত এমনভাবে যে দোষ প্রমাণিত হয়, তাহলে সরকার অনেকাংশেই তার দুর্নীতিসংক্রান্ত অপবাদ মোকাবিলা করতে পারত। অন্তত বলতে পারত, আমাদের সময় দুদক চেষ্টা করেছে, অমুক-তমুকের দুর্নীতির জন্য শাস্তি হয়েছে। বর্তমান দুদকের কল্যাণে এমনটি সরকার বলতে পারবে বলে তো আর মনে হয় না।
বলা বাহুল্য, ভোটাররা তো আর দুদকের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট দেবেন না, দুদকের ব্যর্থতার জন্য ভোটাররা দায়ী করছেন সরকারকে। অর্থাৎ ভোট দেবে বর্তমান দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে। দুদকের চেয়ারম্যান আর কমিশনাররা সরকারের কোনো হোমরাচোমরার বিরুদ্ধে তদন্ত-মামলা না করে কারও বিরাগভাজন হচ্ছেন না, এটা ঠিক। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের প্রায় সবাই সম্ভবত দুদকের ব্যাপারে খুবই প্রীত ও সন্তুষ্ট। 
কিন্তু ভোটাররা এটাকে মোটেও ভালোভাবে নেবেন না, সময় এলে। সরকারের বাকি ৩০ ভাগ সময়ে এ দুদক যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে, তা আর এখন বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে না।
অর্থাৎ এই শত্রু বর্তমান সরকারকে— অধমের আশঙ্কা—ঘায়েল করেই ছাড়বে।
ড. শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

কিনার নাইরে'



শাহদীন মালিক
সব মিলিয়ে আমরা অশান্তিতে আছি। এর বেশিরভাগ দায় সরকারি দলের। তবে লাগাতার হরতাল করে বিরোধী দল যথার্থ প্রতিবাদ করছে কিন্তু তা আমাদের অশান্তি কমাচ্ছে না। আমাদের অশান্তি ও দেশের অশান্ত পরিস্থিতিতে বড় দুই দল পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবিলম্বে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে দেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে এই দুই রাজনৈতিক দল থেকে এই দেশের ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য নতুন দল খুঁজবে


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশাল সমুদ্রজয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সবাই আনন্দিত ও উৎফুল্ল। এর সঙ্গে আমরা আশা করব, শুধু ভারতের বিরুদ্ধে আরও সমুদ্রজয় হবে না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্রমান্বয়ে ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরও বাংলাদেশের জন্য জয় করবেন। আপাতত যে সমুদ্রজয় হয়েছে সেই সমুদ্র থেকে অবশ্যই সম্পদ আহরণ হবে। গ্যাস, তেল আরও অন্যান্য খনিজসম্পদের জন্য বহু বড় বড় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কোটি কোটি টাকার চুক্তি সম্পাদন হবে। এই বিশাল সমুদ্রজয়ের পর সমুদ্রের সম্পদ আহরণের জন্য বড় বড় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে এই চুক্তিগুলো খোলামেলা হওয়া উচিত। দেশের সব খনিজসম্পদের মালিক জনগণ। অর্থাৎ আমি, আপনি, দেশের নাগরিক আমরা সবাই এই সম্পদের মালিক। আমাদের সম্পত্তি নিয়ে, আমাদের পক্ষ হয়ে সরকার কার সঙ্গে কী চুক্তি করছে সেটা জানার অধিকার আমাদের সবার আছে। আমাকে না জানিয়ে আমার সম্পত্তির ব্যাপারে অন্যের সঙ্গে চুক্তি করা যায় না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তেল-গ্যাস সংক্রান্ত চুক্তিতে বহু বছর ধরেই বিশাল বিশাল দুর্নীতি হয়েছে। সেই দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ নতুন কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশে এই চুক্তিগুলো প্রকাশ করা সংক্রান্ত আইনও হয়েছে। আমাদেরও প্রথমত সেই আইন হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, আইন না হলেও কোনো বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে তেল-গ্যাস নিয়ে এখন যে নতুন নতুন চুক্তি হবে তা আমাদের না জানিয়ে করা যাবে না। করলে আমরা ধরে নেব সমুদ্রজয়ের ফল শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার আশপাশের প্রিয়জনেরাই ভোগ করবেন। তখন তা হবে কেবল প্রধানমন্ত্রীর সমুদ্রজয়, দেশের সমুদ্রজয় নয়। উপরের এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, ইদানীং স্থলভাগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন অত্যন্ত নড়বড়ে হয়ে গেছে। ক্রমাগত একের পর এক ঘটনা ও দুর্ঘটনায় একদিকে যেমন সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়ছে, অন্যদিকে জনগণেরও অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা বাড়ছে।
আমরা সবাই খুব অশান্তিতে আছি। প্রথমত, কতগুলো লোমহর্ষক অপরাধের কোনো সুরাহা না হওয়া; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পদে থাকা বা পদে না থাকার ব্যাপারে খুব সাদামাটা আইনি ব্যাপারগুলোকে সাংঘাতিক ঘোলাটে করে ফেলা; তৃতীয়ত, হাতেনাতে ধরা দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে টালবাহানা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আইনের বাইরে এবং জবাবদিহিতার লেশমাত্র না থাকা। সব মিলিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা ও অশান্তির প্রেক্ষাপটে সমুদ্র বিজয়ের উৎসব সেটা যত ঘটা করে হোক না কেন তা আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে না। চলমান উদ্বেগজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সোহেল তাজের পদে থাকা না থাকা এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে ঘোলা জল সরকারের আইন ও সুশাসন বিষয়ে চরম খামখেয়ালিপনা ও অদক্ষতার পরিচায়ক।
স্পষ্টত সোহেল তাজ তার প্রতিমন্ত্রী পদেও থাকতে চাননি, এখন সংসদ সদস্য পদেও থাকতে চান না। যে পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে চায় তাকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেশ পরিচালনা সংক্রান্ত মধ্যযুগীয়, সামন্তবাদী চিন্তার নোংরা বহিঃপ্রকাশ। উনিশ শতকে জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার বহু এলাকা থেকে হাজার হাজার প্রজা ভেগে গিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করেছিল। এই ভেগে যাওয়া প্রজাদের নতুন বসতি স্থাপন প্রক্রিয়াই পদ্মার দক্ষিণে বর্তমানে দক্ষিণ বাংলাদেশে বসতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু জমিদাররা প্রজাদের চলে যাওয়ায় সবসময় বাধা দিত। পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করা বা গ্রহণ করতে টালবাহানা, এ সংক্রান্ত উদ্ভট আইনি প্রশ্নের অবতারণ ইত্যাদি সবই সহকর্মীদের আজ্ঞাবহ অধীন হিসেবে গণ্য করার চিন্তাচেতনা বলে কেউ যদি মনে করে, তাহলে তার সঙ্গে তর্ক করা কঠিন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের উচিত ছিল আইনি অবস্থান প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরা এবং বলা যে, যেহেতু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল সেহেতু তাকে মন্ত্রীর পদে রাখতে হলে পুনরায় শপথবাক্য পাঠ করানো আইনসিদ্ধ হতো। আর জনগণ তার করের টাকায় কোনো কাজ না করা, দায়দায়িত্ব পালন না করা ব্যক্তিকে মন্ত্রীর সব সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতা দেবে কি-না সেটা জনগণের কাছ থেকে জেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, দফতরবিহীন মন্ত্রীর সব খরচ জনগণকেই বহন করতে হবে। আমাদের ধারণা, আমরা যেহেতু কোনো কাজ না করে বেতন-ভাতা পাই না সেহেতু আমরাও যিনি কোনো কাজ করবেন না অর্থাৎ দফতরবিহীন মন্ত্রীর বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার খরচ এবং গাড়ির জন্য খরচ দিতে প্রস্তুত নই।
পদত্যাগের এ ব্যাপারগুলো থেকে জনগণের এই ধারণা আরও সুদৃঢ় হচ্ছে যে, সরকার বা সরকারপ্রধান আইনের কোনো ব্যাপারেই তোয়াক্কা করে না। এখানে তার ইচ্ছা যেটাকে তার কঠিন সমালোচকরা বলেন জেদ ও অন্যান্য হিসাব-নিকাশই মুখ্য, আইন-সংবিধান এখানে গৌণ।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল সমুদ্র তো জয় করতে পারেইনি, স্থলভাগের ব্যাপারেও তারা জনগণের যে খুব বেশি আস্থা অর্জন করতে পারছেন তা মনে হচ্ছে না। তবে তাদের সাংগঠনিক সম্পাদক গুম হয়ে যাওয়ায় তারা রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা যথার্থ ও যৌক্তিক ইস্যু পেয়েছেন। এই ইস্যুতে হরতাল হয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে আরও হরতাল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু আপাতত হরতালের পক্ষে জনসমর্থন থাকলেও এই জনসমর্থন দু'চারদিনের বেশি থাকবে না। আমাদের হরতালে নিরীহ লোক নিহত হয়, ভাংচুর, অগি্নসংযোগ ও সম্পত্তির বিনষ্ট হয়, লাখ লাখ লোকের রুজি-রোজগার ব্যাহত হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়, বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমে যায় অর্থাৎ হরতালের বিপক্ষে যুক্তির তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বিরোধী দলের হরতাল ছাড়া গত্যন্তর নেই এবং গত ২০ বছরে বিএনপি থেকে হরতাল আওয়ামী লীগ করেছে অনেক বেশি। তবে এখানে মুখ্য প্রশ্ন হলো, বিএনপির আন্দোলন দেশকে শুধু অস্থিতিশীল করবে, নাকি একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে।
উভয় প্রধান দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখনই যদি আলাপ-আলোচনা শুরু না করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এবং সংসদ কার্যকর করার প্রশ্নে বড় দাগে কয়েকটা বিষয়ে সহযোগিতামূলক অবস্থান না আসে, তাহলে জনদুর্ভোগ ও জনঅশান্তি খুব তাড়াতাড়ি এতটাই বেড়ে যাবে যে জনগণই তখন নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দেবে।
আমাদের ধারণা, এখন একটা জরিপ হলে দেখা যাবে যে, আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা নিকট অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। উভয় রাজনৈতিক দলকে তাদের প্রতি জনগণের এই আস্থাহীনতাকে অবিলম্বেই কমাতে হবে। সেটা না করে তারা যদি একে অপরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি করে, অতীত নিয়ে জঘন্য ভাষায় সমালোচনা করা চালিয়ে যান এবং অতীতের মতোই কাজ করতে থাকেন, তাহলে এই দেশে নতুন বড় রাজনৈতিক দলের উত্থান খুব দূরের ব্যাপার থাকবে না।
মোদ্দাকথা, সব মিলিয়ে আমরা অশান্তিতে আছি। এর বেশিরভাগ দায় সরকারি দলের। তবে লাগাতার হরতাল করে বিরোধী দল যথার্থ প্রতিবাদ করছে কিন্তু তা আমাদের অশান্তি কমাচ্ছে না। আমাদের অশান্তি ও দেশের অশান্ত পরিস্থিতিতে বড় দুই দল পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবিলম্বে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে দেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে এই দুই রাজনৈতিক দল থেকে এই দেশের ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য নতুন দল খুঁজবে।


ড. শাহদীন মালিক : পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

চলতি রাজনীতিঃ প্রধানমন্ত্রীর আইন ও বক্তৃতা উপদেষ্টা



মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা কতজন, তা সঠিক জানা নেই। অন্তত আধা ডজন হবেন বলে ধারণা। কয়েকজন উপদেষ্টা সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে সুপরিচিত। যেমন, খোদ প্রধানমন্ত্রী একাধারে বিদ্যুৎমন্ত্রীও বটে; তদুপরি তাঁর আছেন একজন বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা। ফলাফল—আমরা বিদ্যুৎহীন। অবশ্য এই বিদ্যুৎহীনতার কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই আমাদের মনে করিয়ে দেন—বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এই ‘কারণ দর্শানো’তে আমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট। যেহেতু বিএনপি তার শাসনামলে (২০০১ থেকে ২০০৬) বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি সেহেতু আওয়ামী লীগ শাসনামলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকবে না। তথাস্তু।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ গোছের নিখাদ যৌক্তিক কথা ও বক্তব্য শুনে মনে হয় যে আমরা না জানলেও আড়ালে-আবডালে তাঁর নিশ্চয় আইন ও বক্তৃতাবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন, যাঁরা প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ উপদেষ্টার মতো তাঁকে ভীষণভাবে উপদেশ দিয়ে চলছেন। সেসব উপদেশ অনুযায়ীই প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ভীষণ বক্তব্য উপস্থাপন করছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গত দু-তিন দিনের বক্তব্যের ব্যাপারে ২১ এপ্রিল মিজানুর রহমান খান (মন্ত্রিসভার বৈধতা ও শহীদ সোলেমান পরিবারের প্রার্থনা) ও সোহরাব হাসানের (প্রধানমন্ত্রী কি ঠিক বলছেন?) দুটি লেখা ছাপা হয়েছে। অনেক ব্যাপারেই যাঁরা সরকারের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে আছেন, তাঁরা প্রযোজ্য আইনগুলো না-ও জানতে পারেন। সব আইন সবার পক্ষে সব সময় জানা সম্ভব নয়। আবার মাঝেমধ্যে জানার ক্ষেত্রেও ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। কিন্তু অন্তত কে কীভাবে মন্ত্রী হন এবং সেই সঙ্গে মন্ত্রীর পদ কীভাবে শূন্য হয় অন্তত এই আইনি জ্ঞান তো আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।
সোহেল তাজ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্ত্রিত্বসংক্রান্ত সব তুঘলকি কাণ্ড দেখে এটা স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে এসব ব্যাপারে সংবিধানে যে কিছু বলা আছে, সেটাও বোধ হয় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জানেন না। এবং জানেন না বলেই তোয়াক্কা করেন না।
মিজানুর রহমান খানের বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছি—মন্ত্রী পদত্যাগপত্র প্রদান করলেই তাঁর পদ শূন্য হয়ে যায়। মন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা বা না করার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির নেই। অন্যান্য পদে নিয়োগপত্র পেলে যে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে তাকে একটা যোগদানপত্র দিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু মন্ত্রীকে যোগদানপত্র দিতে হয় না। যেসব সাংবিধানিক পদে শপথ নিতে হয় সেসব পদের জন্য শপথ নেওয়াটাই হলো যোগদানপত্র। অর্থাৎ শপথবাক্য পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গেই পদে বহাল হোন মন্ত্রী ও অন্যান্য সাংবিধানিক পদাধিকারীরা। সে জন্য আমরা টেলিভিশনের খবরে দেখি মামুলি গাড়িতে বঙ্গভবনে প্রবেশ আর সেখানে শপথ নিয়ে ‘ফ্লাগ’ উড়িয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ।
যোগদানপত্র যেমন দিতে হয় না, তেমনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার বা না করার বিধান নেই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হয়তো ‘হুক্কুমুক্কু’ দিতে পারেন অর্থাৎ বলতে পারেন আমি শুধু মুখে বলেছি পদত্যাগ করব কিন্তু আসলে লিখিত দিইনি। এ গোছের হুক্কুমুক্কু দিয়ে নিজের পায়ে আবার সজোরে ও ভীষণ উৎসাহে কুড়াল মারতে পারেন। কিন্তু সোহেল তাজ তো প্রায় বছর তিন ধরে পদত্যাগ করার চেষ্টা করছেন। তাঁর পদত্যাগপত্র নাকি ‘গৃহীত’ হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগতভাবে আইনপরিপন্থী কাজ করছেন। তাই বলছিলাম আজগুবি সব উপদেশ দেওয়ার জন্য তাঁর নিশ্চয় আইন উপদেষ্টা আছেন।
সেই আইন উপদেষ্টাই হয়তো ‘দপ্তরবিহীন’ মন্ত্রীর ব্যাপারটা চালু করেছেন। ১৯৬২ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রের প্রস্তাবনায় আছে যে সে সময়ের পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানের জনগণের জন্য (সে সময় আমরাও পাকিস্তান ছিলাম) সেই শাসনতন্ত্র রচনা ও প্রদান করেছিলেন। যেন অনেকটা দয়াপরবশ হয়ে।
ওই ধরনের সময় বা পাকিস্তানি কায়দার শাসনব্যবস্থায় দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকতে পারে। অর্থাৎ এমন ব্যক্তি থাকতে পারেন যিনি গাড়িতে রাষ্ট্রের পতাকা লাগিয়ে মন্ত্রীর সব সুযোগসুবিধা ভোগ করে বহাল তবিয়তে থাকবেন, অথচ তাঁর কোনো কাজ থাকবে না বা কোনো কাজ করবেন না। দপ্তরই তো নেই—দপ্তরবিহীন মন্ত্রী—অতএব, কাজ করবেন কীভাবে?
তাহলে কাজকর্ম না করে বেতন-ভাতাদি নিচ্ছেন কীভাবে? গাড়ির জ্বালানি, গাড়িচালকের বেতন, মন্ত্রীর বাসার গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি? দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী থাকে কি না, জানি না। মন্ত্রী তো বেতন পান। এত সব টাকার প্রতিটি পাই-পয়সা আসে জনগণের করের টাকা থেকে। কাজ না করে মন্ত্রী যদি বেতন-ভাতাদি পেতে পারেন, তাহলে সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীও তো কাজ না করে মাস শেষে বেতন দাবি করতে পারেন।
একটা নীতিবান লোক কেমন করে কাজ না করে, কোনো দায়িত্ব পালন না করে জনগণের অর্থে ভাগ বসাতে পারেন, সেটা মোটেও বোধগম্য নয়। অবশ্য নীতি-নৈতিকতা, আইন সংবিধান—কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করলে সবই সম্ভব।

২.
সোহরাব হাসানের লেখায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাবিষয়ক উপদেষ্টার নৈপুণ্য খুবই উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। সেই একই উপদেষ্টা বোধ হয় মাঝেমধ্যে আইন প্রতিমন্ত্রীকেও বক্তৃতার ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। কারণ, ২০ এপ্রিল রাতে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখলাম (এবং শুনলাম) যে আইন প্রতিমন্ত্রী বলছেন চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা জামালউদ্দীনকে যেমন বিএনপিরই লোকেরা অপহরণ করে হত্যা করেছিল, ইলিয়াস আলীর ব্যাপারেও সে রকমটি হতে পারে। প্রতিমন্ত্রী এত জলদি ‘জানিল কেমনে’?
লেখার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে একটা পাদটীকা লেখার মাঝখানেই দিয়ে রাখি। দিনকাল খারাপ। আইন প্রতিমন্ত্রীর উপরোল্লিখিত কথাগুলো যত দূর মনে পড়ছে সেভাবেই লিখছি। টেলিভিশনের সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে খাতায় টুকে রাখিনি বা টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করিনি। তাই যদি দু-একটা শব্দ এদিক-ওদিক হয়ে যায় তাহলে হলফ করে বলছি দেশে কোনো ধরনের তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটানো বা দেশদ্রোহ করা অধমের স্বপ্নেরও বাইরে। তা-ও পাদটীকা আকারে বলে রাখছি, কারণ বলা তো যায় না আইন প্রতিমন্ত্রীর কোনো তোষামোদকারী তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কখন দেশদ্রোহের মামলা ঠুকে দেয়। আর আদালতও বাকস্বাধীনতা রক্ষা করার পরিবর্তে সরকারের সমালোচকদের ঠেসে ধরা পবিত্র দায়িত্ব মনে করে পত্রপাঠ জেলে পাঠিয়ে দেন।
আইনের জ্ঞানের আকাল সর্বগ্রাসী হয়ে পড়ছে। এই আকালটা এখন শুধু প্রধানমন্ত্রী, দপ্তরবিহীন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীদের অফিসেই সীমাবদ্ধ নয়।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-উপদেষ্টা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সোহরাব হাসান যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ হয়ে তাঁর প্রেস সচিবের অন্তত এ বিষয়ে প্রেসনোট বা সে জাতীয় কোনো ব্যাখ্যা প্রদান বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অন্তত অধমের মতো তাঁর সমালোচকের দৃষ্টিতে আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্নতার দোষে দুষ্ট। তদুপরি তাঁর ব্যবহূত ভাষা কটাক্ষ, তির্যকতা ইত্যাদি কিশোর-যুবাদের মোটেও অনুকরণীয় হওয়া উচিত নয়। তাহলে আমাদের অসভ্যতা ও বর্বরতা আরও সর্বগ্রাসী হওয়ার আশঙ্কা প্রকট হবে।
অতএব, প্রধানমন্ত্রী হয় বক্তৃতা কম দেবেন অথবা তাঁর বক্তৃতাবিষয়ক উপদেষ্টা বদল করবেন। বলা বাহুল্য, বিদ্যুৎ উপদেষ্টা পরিবর্তন করে বা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অন্য কাউকে এখন দিলেও বিদ্যুৎসংক্রান্ত জনরোষ থেকে এই সরকারের পরিত্রাণ নেই।
৩.
ইলিয়াস আলী ও র‌্যাব। অর্ধযুগ হলো র‌্যাব নিয়ে চেঁচামেচি করছি—লেখালেখিতে আর টক শোতে। ইনিয়ে-বিনিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সোজাসুজি বা ঘুল্লি পথে বলেছি কিন্তু কথা একটাই। যখন ক্রসফায়ার শুরু হয়েছে তখন থেকে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করতে দিলে সেই দোষ একদিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যে একবার-দুবার মানুষ খুন করে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে, সে আবার খুন করবে। তারপর ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, গুপ্তহত্যা, গুম—ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথম আলো ২০ এপ্রিল ২০১২ হিসাব দিয়েছে ১০০ জনের। ছয় মাস পর এ সংখ্যাটা কত হবে ভাবতেই শিউরে উঠছি।
মাঝেমধ্যে র‌্যাবের গুণগান হবে বা বৈধতা জায়েজ করার চেষ্টা চলবে—যেমন, আদালত কর্তৃক সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত র‌্যাবকে দেওয়া বা প্রথম আলোতে হাফিজুর রহমানের সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রকাশিত লেখা। এটাও সত্যি যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে র‌্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো কাজ করবে—অর্থাৎ সন্ত্রাসী, খুনি, জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করবে। তবে ক্রমান্বয়ে আইনি কাজ করার চেয়ে বেআইনি কাজই বেশি করবে। এখন তো শুধু একজন-দুজন করে মারে না, মারে একেবারে পাঁচ-ছয়জন করে (নরসিংদী)। আর ছোট এলাকার ছোট নেতার পরিবর্তে এখন গায়েব হয়ে যাচ্ছেন ইলিয়াস আলীর মতো জাতীয় নেতা।
বিএনপির নেতাদের স্মরণ করা উচিত যে র‌্যাব শুরু করেছিলেন তাঁরাই। আর আওয়ামী লীগের নেতাদের মনে রাখতে হবে যে ২০১৩ সালের পর তাঁদের ক্ষমতায় না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তখন আপনাদের অনেকেই ইলিয়াস আলীর মতো হবেন সাবেক সাংসদ। আর এখনই ব্যবস্থা না নিলে র‌্যাব কিন্তু থাকবে। তত দিন থাকলে আরও অন্তত শ দুয়েক ক্রসফায়ার, গুম, গুপ্তহত্যার ‘অভিজ্ঞতার ভান্ডার’ থাকবে র‌্যাবের ঝুলিতে।
অবশ্য তত দিনে আমরা এসব গায়েব হয়ে যাওয়ায় আরও অনেক বেশি অভ্যস্ত হয়ে যাব। তত দিনে ভয়ে লেখালেখিও বন্ধ হয়ে যাবে। গুম-গায়েব হলে আর হরতাল হবে না। আমরা তখন দোষ দেব আপনাদের দলের লোকদেরই। কারণ, র‌্যাবের দিকে আঙুল দেখানোর সাহস তত দিনে আমাদের আর থাকবে না।
এভাবে চলতে থাকলে দেশে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদের আকাল পড়বে। বহাল তবিয়তে শুধু থাকবে র‌্যাব। তাই শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আশরাফ আর মির্জা ফখরুল সাহেবদের কাছে করজোড়ে নিবেদন—প্লিজ, আজই বসেন। সিদ্ধান্ত নিন, যে-ই ক্ষমতায় থাকুক, কোনো বাহিনীকেই আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে দেওয়া আর হবে না। সবচেয়ে ভালো হয় র‌্যাব বিলুপ্ত করলে। তাহলে আপনারা-আমরা অনেকেই জানে বেঁচে যাব।
অধমের পৈতৃক নিবাস ইলিয়াস আলীর সেই একই বিশ্বনাথ থানায়। ঢাকায় আমাদের বাড়ির নাম ‘সরুয়ালা’। অর্থাৎ বিশ্বনাথের দাদাবাড়ির সরুয়ালা গ্রামের নামে। অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে সেই স্থানীয়তার সুবাদেও প্রার্থনা করছি—ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক ফিরে আসুন সুস্থ শরীরে।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।