রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

কিনার নাইরে'



শাহদীন মালিক
সব মিলিয়ে আমরা অশান্তিতে আছি। এর বেশিরভাগ দায় সরকারি দলের। তবে লাগাতার হরতাল করে বিরোধী দল যথার্থ প্রতিবাদ করছে কিন্তু তা আমাদের অশান্তি কমাচ্ছে না। আমাদের অশান্তি ও দেশের অশান্ত পরিস্থিতিতে বড় দুই দল পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবিলম্বে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে দেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে এই দুই রাজনৈতিক দল থেকে এই দেশের ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য নতুন দল খুঁজবে


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশাল সমুদ্রজয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সবাই আনন্দিত ও উৎফুল্ল। এর সঙ্গে আমরা আশা করব, শুধু ভারতের বিরুদ্ধে আরও সমুদ্রজয় হবে না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্রমান্বয়ে ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরও বাংলাদেশের জন্য জয় করবেন। আপাতত যে সমুদ্রজয় হয়েছে সেই সমুদ্র থেকে অবশ্যই সম্পদ আহরণ হবে। গ্যাস, তেল আরও অন্যান্য খনিজসম্পদের জন্য বহু বড় বড় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কোটি কোটি টাকার চুক্তি সম্পাদন হবে। এই বিশাল সমুদ্রজয়ের পর সমুদ্রের সম্পদ আহরণের জন্য বড় বড় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে এই চুক্তিগুলো খোলামেলা হওয়া উচিত। দেশের সব খনিজসম্পদের মালিক জনগণ। অর্থাৎ আমি, আপনি, দেশের নাগরিক আমরা সবাই এই সম্পদের মালিক। আমাদের সম্পত্তি নিয়ে, আমাদের পক্ষ হয়ে সরকার কার সঙ্গে কী চুক্তি করছে সেটা জানার অধিকার আমাদের সবার আছে। আমাকে না জানিয়ে আমার সম্পত্তির ব্যাপারে অন্যের সঙ্গে চুক্তি করা যায় না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তেল-গ্যাস সংক্রান্ত চুক্তিতে বহু বছর ধরেই বিশাল বিশাল দুর্নীতি হয়েছে। সেই দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ নতুন কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশে এই চুক্তিগুলো প্রকাশ করা সংক্রান্ত আইনও হয়েছে। আমাদেরও প্রথমত সেই আইন হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, আইন না হলেও কোনো বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে তেল-গ্যাস নিয়ে এখন যে নতুন নতুন চুক্তি হবে তা আমাদের না জানিয়ে করা যাবে না। করলে আমরা ধরে নেব সমুদ্রজয়ের ফল শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার আশপাশের প্রিয়জনেরাই ভোগ করবেন। তখন তা হবে কেবল প্রধানমন্ত্রীর সমুদ্রজয়, দেশের সমুদ্রজয় নয়। উপরের এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, ইদানীং স্থলভাগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন অত্যন্ত নড়বড়ে হয়ে গেছে। ক্রমাগত একের পর এক ঘটনা ও দুর্ঘটনায় একদিকে যেমন সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়ছে, অন্যদিকে জনগণেরও অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা বাড়ছে।
আমরা সবাই খুব অশান্তিতে আছি। প্রথমত, কতগুলো লোমহর্ষক অপরাধের কোনো সুরাহা না হওয়া; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পদে থাকা বা পদে না থাকার ব্যাপারে খুব সাদামাটা আইনি ব্যাপারগুলোকে সাংঘাতিক ঘোলাটে করে ফেলা; তৃতীয়ত, হাতেনাতে ধরা দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে টালবাহানা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আইনের বাইরে এবং জবাবদিহিতার লেশমাত্র না থাকা। সব মিলিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা ও অশান্তির প্রেক্ষাপটে সমুদ্র বিজয়ের উৎসব সেটা যত ঘটা করে হোক না কেন তা আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে না। চলমান উদ্বেগজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সোহেল তাজের পদে থাকা না থাকা এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে ঘোলা জল সরকারের আইন ও সুশাসন বিষয়ে চরম খামখেয়ালিপনা ও অদক্ষতার পরিচায়ক।
স্পষ্টত সোহেল তাজ তার প্রতিমন্ত্রী পদেও থাকতে চাননি, এখন সংসদ সদস্য পদেও থাকতে চান না। যে পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে চায় তাকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেশ পরিচালনা সংক্রান্ত মধ্যযুগীয়, সামন্তবাদী চিন্তার নোংরা বহিঃপ্রকাশ। উনিশ শতকে জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার বহু এলাকা থেকে হাজার হাজার প্রজা ভেগে গিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করেছিল। এই ভেগে যাওয়া প্রজাদের নতুন বসতি স্থাপন প্রক্রিয়াই পদ্মার দক্ষিণে বর্তমানে দক্ষিণ বাংলাদেশে বসতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু জমিদাররা প্রজাদের চলে যাওয়ায় সবসময় বাধা দিত। পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করা বা গ্রহণ করতে টালবাহানা, এ সংক্রান্ত উদ্ভট আইনি প্রশ্নের অবতারণ ইত্যাদি সবই সহকর্মীদের আজ্ঞাবহ অধীন হিসেবে গণ্য করার চিন্তাচেতনা বলে কেউ যদি মনে করে, তাহলে তার সঙ্গে তর্ক করা কঠিন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের উচিত ছিল আইনি অবস্থান প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরা এবং বলা যে, যেহেতু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল সেহেতু তাকে মন্ত্রীর পদে রাখতে হলে পুনরায় শপথবাক্য পাঠ করানো আইনসিদ্ধ হতো। আর জনগণ তার করের টাকায় কোনো কাজ না করা, দায়দায়িত্ব পালন না করা ব্যক্তিকে মন্ত্রীর সব সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতা দেবে কি-না সেটা জনগণের কাছ থেকে জেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, দফতরবিহীন মন্ত্রীর সব খরচ জনগণকেই বহন করতে হবে। আমাদের ধারণা, আমরা যেহেতু কোনো কাজ না করে বেতন-ভাতা পাই না সেহেতু আমরাও যিনি কোনো কাজ করবেন না অর্থাৎ দফতরবিহীন মন্ত্রীর বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার খরচ এবং গাড়ির জন্য খরচ দিতে প্রস্তুত নই।
পদত্যাগের এ ব্যাপারগুলো থেকে জনগণের এই ধারণা আরও সুদৃঢ় হচ্ছে যে, সরকার বা সরকারপ্রধান আইনের কোনো ব্যাপারেই তোয়াক্কা করে না। এখানে তার ইচ্ছা যেটাকে তার কঠিন সমালোচকরা বলেন জেদ ও অন্যান্য হিসাব-নিকাশই মুখ্য, আইন-সংবিধান এখানে গৌণ।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল সমুদ্র তো জয় করতে পারেইনি, স্থলভাগের ব্যাপারেও তারা জনগণের যে খুব বেশি আস্থা অর্জন করতে পারছেন তা মনে হচ্ছে না। তবে তাদের সাংগঠনিক সম্পাদক গুম হয়ে যাওয়ায় তারা রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা যথার্থ ও যৌক্তিক ইস্যু পেয়েছেন। এই ইস্যুতে হরতাল হয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে আরও হরতাল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু আপাতত হরতালের পক্ষে জনসমর্থন থাকলেও এই জনসমর্থন দু'চারদিনের বেশি থাকবে না। আমাদের হরতালে নিরীহ লোক নিহত হয়, ভাংচুর, অগি্নসংযোগ ও সম্পত্তির বিনষ্ট হয়, লাখ লাখ লোকের রুজি-রোজগার ব্যাহত হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়, বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমে যায় অর্থাৎ হরতালের বিপক্ষে যুক্তির তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বিরোধী দলের হরতাল ছাড়া গত্যন্তর নেই এবং গত ২০ বছরে বিএনপি থেকে হরতাল আওয়ামী লীগ করেছে অনেক বেশি। তবে এখানে মুখ্য প্রশ্ন হলো, বিএনপির আন্দোলন দেশকে শুধু অস্থিতিশীল করবে, নাকি একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে।
উভয় প্রধান দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখনই যদি আলাপ-আলোচনা শুরু না করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এবং সংসদ কার্যকর করার প্রশ্নে বড় দাগে কয়েকটা বিষয়ে সহযোগিতামূলক অবস্থান না আসে, তাহলে জনদুর্ভোগ ও জনঅশান্তি খুব তাড়াতাড়ি এতটাই বেড়ে যাবে যে জনগণই তখন নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দেবে।
আমাদের ধারণা, এখন একটা জরিপ হলে দেখা যাবে যে, আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা নিকট অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। উভয় রাজনৈতিক দলকে তাদের প্রতি জনগণের এই আস্থাহীনতাকে অবিলম্বেই কমাতে হবে। সেটা না করে তারা যদি একে অপরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি করে, অতীত নিয়ে জঘন্য ভাষায় সমালোচনা করা চালিয়ে যান এবং অতীতের মতোই কাজ করতে থাকেন, তাহলে এই দেশে নতুন বড় রাজনৈতিক দলের উত্থান খুব দূরের ব্যাপার থাকবে না।
মোদ্দাকথা, সব মিলিয়ে আমরা অশান্তিতে আছি। এর বেশিরভাগ দায় সরকারি দলের। তবে লাগাতার হরতাল করে বিরোধী দল যথার্থ প্রতিবাদ করছে কিন্তু তা আমাদের অশান্তি কমাচ্ছে না। আমাদের অশান্তি ও দেশের অশান্ত পরিস্থিতিতে বড় দুই দল পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবিলম্বে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে দেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে এই দুই রাজনৈতিক দল থেকে এই দেশের ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য নতুন দল খুঁজবে।


ড. শাহদীন মালিক : পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

চলতি রাজনীতিঃ প্রধানমন্ত্রীর আইন ও বক্তৃতা উপদেষ্টা



মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা কতজন, তা সঠিক জানা নেই। অন্তত আধা ডজন হবেন বলে ধারণা। কয়েকজন উপদেষ্টা সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে সুপরিচিত। যেমন, খোদ প্রধানমন্ত্রী একাধারে বিদ্যুৎমন্ত্রীও বটে; তদুপরি তাঁর আছেন একজন বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা। ফলাফল—আমরা বিদ্যুৎহীন। অবশ্য এই বিদ্যুৎহীনতার কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই আমাদের মনে করিয়ে দেন—বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এই ‘কারণ দর্শানো’তে আমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট। যেহেতু বিএনপি তার শাসনামলে (২০০১ থেকে ২০০৬) বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি সেহেতু আওয়ামী লীগ শাসনামলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকবে না। তথাস্তু।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ গোছের নিখাদ যৌক্তিক কথা ও বক্তব্য শুনে মনে হয় যে আমরা না জানলেও আড়ালে-আবডালে তাঁর নিশ্চয় আইন ও বক্তৃতাবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন, যাঁরা প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ উপদেষ্টার মতো তাঁকে ভীষণভাবে উপদেশ দিয়ে চলছেন। সেসব উপদেশ অনুযায়ীই প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ভীষণ বক্তব্য উপস্থাপন করছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গত দু-তিন দিনের বক্তব্যের ব্যাপারে ২১ এপ্রিল মিজানুর রহমান খান (মন্ত্রিসভার বৈধতা ও শহীদ সোলেমান পরিবারের প্রার্থনা) ও সোহরাব হাসানের (প্রধানমন্ত্রী কি ঠিক বলছেন?) দুটি লেখা ছাপা হয়েছে। অনেক ব্যাপারেই যাঁরা সরকারের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে আছেন, তাঁরা প্রযোজ্য আইনগুলো না-ও জানতে পারেন। সব আইন সবার পক্ষে সব সময় জানা সম্ভব নয়। আবার মাঝেমধ্যে জানার ক্ষেত্রেও ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। কিন্তু অন্তত কে কীভাবে মন্ত্রী হন এবং সেই সঙ্গে মন্ত্রীর পদ কীভাবে শূন্য হয় অন্তত এই আইনি জ্ঞান তো আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।
সোহেল তাজ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্ত্রিত্বসংক্রান্ত সব তুঘলকি কাণ্ড দেখে এটা স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে এসব ব্যাপারে সংবিধানে যে কিছু বলা আছে, সেটাও বোধ হয় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জানেন না। এবং জানেন না বলেই তোয়াক্কা করেন না।
মিজানুর রহমান খানের বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছি—মন্ত্রী পদত্যাগপত্র প্রদান করলেই তাঁর পদ শূন্য হয়ে যায়। মন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা বা না করার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির নেই। অন্যান্য পদে নিয়োগপত্র পেলে যে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে তাকে একটা যোগদানপত্র দিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু মন্ত্রীকে যোগদানপত্র দিতে হয় না। যেসব সাংবিধানিক পদে শপথ নিতে হয় সেসব পদের জন্য শপথ নেওয়াটাই হলো যোগদানপত্র। অর্থাৎ শপথবাক্য পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গেই পদে বহাল হোন মন্ত্রী ও অন্যান্য সাংবিধানিক পদাধিকারীরা। সে জন্য আমরা টেলিভিশনের খবরে দেখি মামুলি গাড়িতে বঙ্গভবনে প্রবেশ আর সেখানে শপথ নিয়ে ‘ফ্লাগ’ উড়িয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ।
যোগদানপত্র যেমন দিতে হয় না, তেমনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার বা না করার বিধান নেই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হয়তো ‘হুক্কুমুক্কু’ দিতে পারেন অর্থাৎ বলতে পারেন আমি শুধু মুখে বলেছি পদত্যাগ করব কিন্তু আসলে লিখিত দিইনি। এ গোছের হুক্কুমুক্কু দিয়ে নিজের পায়ে আবার সজোরে ও ভীষণ উৎসাহে কুড়াল মারতে পারেন। কিন্তু সোহেল তাজ তো প্রায় বছর তিন ধরে পদত্যাগ করার চেষ্টা করছেন। তাঁর পদত্যাগপত্র নাকি ‘গৃহীত’ হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগতভাবে আইনপরিপন্থী কাজ করছেন। তাই বলছিলাম আজগুবি সব উপদেশ দেওয়ার জন্য তাঁর নিশ্চয় আইন উপদেষ্টা আছেন।
সেই আইন উপদেষ্টাই হয়তো ‘দপ্তরবিহীন’ মন্ত্রীর ব্যাপারটা চালু করেছেন। ১৯৬২ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রের প্রস্তাবনায় আছে যে সে সময়ের পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানের জনগণের জন্য (সে সময় আমরাও পাকিস্তান ছিলাম) সেই শাসনতন্ত্র রচনা ও প্রদান করেছিলেন। যেন অনেকটা দয়াপরবশ হয়ে।
ওই ধরনের সময় বা পাকিস্তানি কায়দার শাসনব্যবস্থায় দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকতে পারে। অর্থাৎ এমন ব্যক্তি থাকতে পারেন যিনি গাড়িতে রাষ্ট্রের পতাকা লাগিয়ে মন্ত্রীর সব সুযোগসুবিধা ভোগ করে বহাল তবিয়তে থাকবেন, অথচ তাঁর কোনো কাজ থাকবে না বা কোনো কাজ করবেন না। দপ্তরই তো নেই—দপ্তরবিহীন মন্ত্রী—অতএব, কাজ করবেন কীভাবে?
তাহলে কাজকর্ম না করে বেতন-ভাতাদি নিচ্ছেন কীভাবে? গাড়ির জ্বালানি, গাড়িচালকের বেতন, মন্ত্রীর বাসার গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি? দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী থাকে কি না, জানি না। মন্ত্রী তো বেতন পান। এত সব টাকার প্রতিটি পাই-পয়সা আসে জনগণের করের টাকা থেকে। কাজ না করে মন্ত্রী যদি বেতন-ভাতাদি পেতে পারেন, তাহলে সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীও তো কাজ না করে মাস শেষে বেতন দাবি করতে পারেন।
একটা নীতিবান লোক কেমন করে কাজ না করে, কোনো দায়িত্ব পালন না করে জনগণের অর্থে ভাগ বসাতে পারেন, সেটা মোটেও বোধগম্য নয়। অবশ্য নীতি-নৈতিকতা, আইন সংবিধান—কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করলে সবই সম্ভব।

২.
সোহরাব হাসানের লেখায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাবিষয়ক উপদেষ্টার নৈপুণ্য খুবই উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। সেই একই উপদেষ্টা বোধ হয় মাঝেমধ্যে আইন প্রতিমন্ত্রীকেও বক্তৃতার ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। কারণ, ২০ এপ্রিল রাতে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখলাম (এবং শুনলাম) যে আইন প্রতিমন্ত্রী বলছেন চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা জামালউদ্দীনকে যেমন বিএনপিরই লোকেরা অপহরণ করে হত্যা করেছিল, ইলিয়াস আলীর ব্যাপারেও সে রকমটি হতে পারে। প্রতিমন্ত্রী এত জলদি ‘জানিল কেমনে’?
লেখার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে একটা পাদটীকা লেখার মাঝখানেই দিয়ে রাখি। দিনকাল খারাপ। আইন প্রতিমন্ত্রীর উপরোল্লিখিত কথাগুলো যত দূর মনে পড়ছে সেভাবেই লিখছি। টেলিভিশনের সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে খাতায় টুকে রাখিনি বা টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করিনি। তাই যদি দু-একটা শব্দ এদিক-ওদিক হয়ে যায় তাহলে হলফ করে বলছি দেশে কোনো ধরনের তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটানো বা দেশদ্রোহ করা অধমের স্বপ্নেরও বাইরে। তা-ও পাদটীকা আকারে বলে রাখছি, কারণ বলা তো যায় না আইন প্রতিমন্ত্রীর কোনো তোষামোদকারী তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কখন দেশদ্রোহের মামলা ঠুকে দেয়। আর আদালতও বাকস্বাধীনতা রক্ষা করার পরিবর্তে সরকারের সমালোচকদের ঠেসে ধরা পবিত্র দায়িত্ব মনে করে পত্রপাঠ জেলে পাঠিয়ে দেন।
আইনের জ্ঞানের আকাল সর্বগ্রাসী হয়ে পড়ছে। এই আকালটা এখন শুধু প্রধানমন্ত্রী, দপ্তরবিহীন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীদের অফিসেই সীমাবদ্ধ নয়।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-উপদেষ্টা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সোহরাব হাসান যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ হয়ে তাঁর প্রেস সচিবের অন্তত এ বিষয়ে প্রেসনোট বা সে জাতীয় কোনো ব্যাখ্যা প্রদান বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অন্তত অধমের মতো তাঁর সমালোচকের দৃষ্টিতে আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্নতার দোষে দুষ্ট। তদুপরি তাঁর ব্যবহূত ভাষা কটাক্ষ, তির্যকতা ইত্যাদি কিশোর-যুবাদের মোটেও অনুকরণীয় হওয়া উচিত নয়। তাহলে আমাদের অসভ্যতা ও বর্বরতা আরও সর্বগ্রাসী হওয়ার আশঙ্কা প্রকট হবে।
অতএব, প্রধানমন্ত্রী হয় বক্তৃতা কম দেবেন অথবা তাঁর বক্তৃতাবিষয়ক উপদেষ্টা বদল করবেন। বলা বাহুল্য, বিদ্যুৎ উপদেষ্টা পরিবর্তন করে বা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অন্য কাউকে এখন দিলেও বিদ্যুৎসংক্রান্ত জনরোষ থেকে এই সরকারের পরিত্রাণ নেই।
৩.
ইলিয়াস আলী ও র‌্যাব। অর্ধযুগ হলো র‌্যাব নিয়ে চেঁচামেচি করছি—লেখালেখিতে আর টক শোতে। ইনিয়ে-বিনিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সোজাসুজি বা ঘুল্লি পথে বলেছি কিন্তু কথা একটাই। যখন ক্রসফায়ার শুরু হয়েছে তখন থেকে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করতে দিলে সেই দোষ একদিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যে একবার-দুবার মানুষ খুন করে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে, সে আবার খুন করবে। তারপর ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, গুপ্তহত্যা, গুম—ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথম আলো ২০ এপ্রিল ২০১২ হিসাব দিয়েছে ১০০ জনের। ছয় মাস পর এ সংখ্যাটা কত হবে ভাবতেই শিউরে উঠছি।
মাঝেমধ্যে র‌্যাবের গুণগান হবে বা বৈধতা জায়েজ করার চেষ্টা চলবে—যেমন, আদালত কর্তৃক সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত র‌্যাবকে দেওয়া বা প্রথম আলোতে হাফিজুর রহমানের সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রকাশিত লেখা। এটাও সত্যি যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে র‌্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো কাজ করবে—অর্থাৎ সন্ত্রাসী, খুনি, জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করবে। তবে ক্রমান্বয়ে আইনি কাজ করার চেয়ে বেআইনি কাজই বেশি করবে। এখন তো শুধু একজন-দুজন করে মারে না, মারে একেবারে পাঁচ-ছয়জন করে (নরসিংদী)। আর ছোট এলাকার ছোট নেতার পরিবর্তে এখন গায়েব হয়ে যাচ্ছেন ইলিয়াস আলীর মতো জাতীয় নেতা।
বিএনপির নেতাদের স্মরণ করা উচিত যে র‌্যাব শুরু করেছিলেন তাঁরাই। আর আওয়ামী লীগের নেতাদের মনে রাখতে হবে যে ২০১৩ সালের পর তাঁদের ক্ষমতায় না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তখন আপনাদের অনেকেই ইলিয়াস আলীর মতো হবেন সাবেক সাংসদ। আর এখনই ব্যবস্থা না নিলে র‌্যাব কিন্তু থাকবে। তত দিন থাকলে আরও অন্তত শ দুয়েক ক্রসফায়ার, গুম, গুপ্তহত্যার ‘অভিজ্ঞতার ভান্ডার’ থাকবে র‌্যাবের ঝুলিতে।
অবশ্য তত দিনে আমরা এসব গায়েব হয়ে যাওয়ায় আরও অনেক বেশি অভ্যস্ত হয়ে যাব। তত দিনে ভয়ে লেখালেখিও বন্ধ হয়ে যাবে। গুম-গায়েব হলে আর হরতাল হবে না। আমরা তখন দোষ দেব আপনাদের দলের লোকদেরই। কারণ, র‌্যাবের দিকে আঙুল দেখানোর সাহস তত দিনে আমাদের আর থাকবে না।
এভাবে চলতে থাকলে দেশে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদের আকাল পড়বে। বহাল তবিয়তে শুধু থাকবে র‌্যাব। তাই শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আশরাফ আর মির্জা ফখরুল সাহেবদের কাছে করজোড়ে নিবেদন—প্লিজ, আজই বসেন। সিদ্ধান্ত নিন, যে-ই ক্ষমতায় থাকুক, কোনো বাহিনীকেই আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে দেওয়া আর হবে না। সবচেয়ে ভালো হয় র‌্যাব বিলুপ্ত করলে। তাহলে আপনারা-আমরা অনেকেই জানে বেঁচে যাব।
অধমের পৈতৃক নিবাস ইলিয়াস আলীর সেই একই বিশ্বনাথ থানায়। ঢাকায় আমাদের বাড়ির নাম ‘সরুয়ালা’। অর্থাৎ বিশ্বনাথের দাদাবাড়ির সরুয়ালা গ্রামের নামে। অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে সেই স্থানীয়তার সুবাদেও প্রার্থনা করছি—ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক ফিরে আসুন সুস্থ শরীরে।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।